বাবার বড় সন্তান হয়ে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কোচিং না করেই অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের জোরে ৪৩ তম বিসিএস এ কৃষিতে মেধাক্রম ৩৭ নিয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মোঃ ইমাম হোসেন জ্যোতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ ( বশেমুরবিপ্রবি) থেকে তিনি ২০১৯ সালে স্মাতক ডিগ্রি অর্জন করেন । তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
চাকরির আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেইসবুক গ্রুপ যুক্ত থাকুন লিংক
বেড়ে ওঠা খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার এক গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়- এএলএম হাইস্কু্ল এর প্রথম বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসাবে এসএসসিতে A+ পাওয়া ছাত্র ছিলাম আমি। ফুলতলা এমএম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত স্নাতক শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগে ২০১৫-১৬ সেশনে ভর্তি হয়ে। হাইস্কুলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলাম আমি। অবশেষে ২০১৯ সালে ৩.৫৫ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করি।
বিসিএস জার্নি শুরু হয় ২০১৯ সালে ৪১তম বিসিএসে এপেয়ার্ড দিয়ে এপ্লাই করে নন ক্যাডারে প্রধান শিক্ষক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।এবং ৪৩তম বিসিএসে বিসিএস কৃষিতে মেধাক্রম-৩৭ নিয়ে সুপারিশ প্রাপ্ত হই। এছাড়া ৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং ৪৫ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।
আমি সবসময় অলরাউন্ডার থাকতে পছন্দ করি। মানে সব কিছুতেই এক্সপার্ট থাকব এমন একটা স্পৃহা কাজ করে। তাই ক্যাম্পাস লাইফে বিসিএস নাকি বাইরের দেশে স্কলারশিপ নিয়ে রিসার্চ এই দুইয়ের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকলেও দুটো ক্যারিয়ারের প্রিপারেশন সমানতালে নেওয়া শুরু করি। কিন্তু শেষবর্ষের প্রথম দিকে আমার খুবই কাছের বন্ধুর বিসিএস প্রিপারেশন নেওয়া দেখে এবং তার সাথে ক্যারিয়ার সংক্রান্ত আলোচনা করে মনে হলো বিসিএসের মাধ্যমে আমি সেটা পূরণ করতে পারব। আর সেভাবেই শুরু হয় অগোছালো তবে ইনফরমেটিভ পড়াশোনা।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সহায়ক হিসাবে ছিলো ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করা পূর্বের ক্যাডার প্রাপ্ত অগ্রজদের দিক নির্দেশনা। যেহেতু আমি কোচিং করিনি তাই আমার বন্ধুই ছিল মূলত আমার মেন্টর। প্রয়োজনীয় পরামর্শ, বই,নোট, রুটিন সবকিছুই তার থেকে সহায়তা নিতাম। স্নাতকের শেষ ছয়মাস ক্যাম্পাস লাইফে ডেইলি এক ঘন্টা গ্রুপ স্টাডি, রুমে রুটিন করে অল্প করে পড়ালেখা শুরু করি। কঠিন বিষয়গুলো গুগুল, ইউটিউব ব্যবহার করে নিজে নিজে সমাধান করতাম। তবে মূল প্রস্তুতি শুরু হয় করোনাকালীন সময়ে। তখন শুধু প্রিলিভিত্তিক পড়াশোনা করেছি প্রচুর।যার ফলাফল ছিল বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রিলি উত্তীর্ণ হওয়া।এরপর ৪১ লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি তবে সেটা সময় স্বল্পতার জন্য একটু কঠিনই ছিল। তাই ৪৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার জন্য দৈনিক গড়ে ১৪ঘন্টা পড়াশোনা করতে হয়েছে। ৪৩তম ভাইভার আগে গড়ে দৈনিক ৪-৫ঘন্টা পড়াশোনা করেছি একটা মিনিমাম প্রিপারেশনের জন্য।
পড়াশোনা ভিত্তিক যে কোনো সমস্যা সমাধানে আমার প্রায়োরিটি ছিলো ফেসবুকের বিভিন্ন বিসিএস ভিত্তিক গ্রুপ, পেজ,অগ্রজদের পোস্টগুলো ফলো করা। বিসিএস সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় পোস্ট, পিডিএফ সেভ করে রাখা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অনলাইনে পত্রিকা পড়া, ইউটিউবে সংবাদ দেখা, গুগুলে তথ্য খোজা সবকিছুই ছিলো বিসিএস প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে।
পত্রিকা পড়া আমার একটা পছন্দের বিষয় ছিল। স্পোর্টস এর পৃষ্ঠা শেষ করে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো খুটিয়ে পড়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। বিসিএস এর প্রিলি প্রস্তুতিকালীন পত্রিকা পড়া গড়ে প্রায় ১-২ ঘন্টা ছিল। লিখিত পরীক্ষার সময় সেটি ২-৩ঘন্টাতে নিয়ে এসেছিলাম। কারণ লিখিত পরীক্ষার সব বিষয় মিলিয়ে প্রায় উন্মুক্ত রচনার ৫০০ মার্কস পত্রিকার তথ্য,বিশ্লেষণ এবং কৌশলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ভাইভার সময় পত্রিকা পড়ার সময় দাঁড়ায় গড়ে ৪-৫ঘন্টা। যা আমার ভাইভা প্রস্তুতির প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন করে দিয়েছিল।
মধ্যবিত্ত পরিবারের এবং বড় সন্তান হওয়ায় পরিবারের বাকি সদস্যদের আশা ছিলো আমাকে নিয়ে। এছাড়া আমার বিসিএস প্রস্তুতির প্রতি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের মানসিক সমর্থন ছায়ার মতই ছিল পুরোটা জার্নিতে। “তুই পারবি” এমন একটা বাক্যই সবসময় সত্যি করে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। আমার এই জার্নি সাবলিল করার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রত্যেকেই তাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ করেছে। পুরো জার্নিতে গুরুজনদের দোয়া,অন্যান্য বন্ধুসহ আমার সবথেকে কাছের বন্ধুর সাপোর্ট এবং বর্তমান কর্মস্থলের আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মীরা প্রত্যেকেই আমার এই সাফল্যের অংশীদার।
বিসিএস একটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ধৈর্য এবং পরিশ্রম এ দুটি গুণ বিসিএসের মূলত চাবিকাঠি। শুধু খেয়াল রাখতে হবে এই দুটি গুণের যেন যথার্থ ব্যবহার হয়।কত ঘন্টা পড়তে হবে,কোন বই পড়তে হবে সেটা মূখ্য বিষয় না। বাজারের প্রায় সব বই একই তথ্যের। তাই যতটুকু সময় পড়ব এবং যা পড়ব তা কতটা কার্যকর সেটা বুঝতে হবে পড়ার সাথে সাথে।এর জন্য একটা রুটিন প্রয়োজন। ইংরেজি এবং গণিত প্রতিদিনের প্র্যাক্টিসের বিষয়।এই দুটি বিষয় ফার্স্ট ইয়ার থেকেই শুরু করা উচিত। এছাড়া দেশ এবং দুনিয়ার হালচাল প্রতিদিন জানা প্রয়োজন একজন সচেতন নাগরিক, শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থী হিসাবে। তবে স্নাতকে একটা ভাল ফলাফল অর্জন করে বিসিএসের জন্য কংক্রিট প্রস্তুতি নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমি মনে করি।
বিসিএস একটা চাকরি মাত্র এবং সেটি দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই প্রেস্টিজিয়াস জব। এর বেশি কিছু না। বিসিএস এর দীর্ঘ জার্নিতে প্রতিদিনই হবে নতুন অভিজ্ঞতা। কখনও হতাশা আবার কখনও আশা এই দুইয়ের দোলাচালে বেকারত্ব জীবন চলবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এবং সেটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত। এই যৌবনে এমন উথাল-পাতাল সময়টা প্রতিটা ব্যক্তির জীবনেই কমবেশি সময়ের জন্য আসে। তাই হতাশ না হয়ে যে যার ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার নিকট চাইবে এমম সাধ্য অনুযায়ী পরিশ্রম করবে এমনটাই হওয়া উচিত। আমাদের যার ভাগ্যে যতটুকু আছে ঠিক ততটুকু আসবেই এবং ততটুকুই সৃষ্টিকর্তা আমার মংগলের জন্য রেখেছে এমন বিশ্বাস মনকে শান্ত এবং সুস্থির করতে পারে লক্ষ্যে পৌঁছাতে❞
বিসিএস এর রেজাল্টের দিন স্বাভাবিকভাবেই একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। পছন্দের ক্যাডার পাওয়ার একটা বাসনা চওড়া হচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে । যখন ফলাফল লিস্টে নিজের রোলটা দেখলাম তখন কয়েকজনকে দিয়ে চেক করালাম যেন দৃষ্টি বিভ্রান্তি না ঘটে উত্তেজনায় । এরপরের বাকিসময়টা শুভাকাঙ্ক্ষীদের অভিনন্দন এবং শুভকামনায় কাটলো। ফাইনালি আমি ক্যাডার হয়েছি, আমার প্রতি যাদের বিশ্বাস ছিল তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে মহান আল্লাহর নিকট শুকরিয়া স্বরূপ নামাজ পড়েছি। দীর্ঘ চাকরি পরীক্ষা প্রস্তুতির একটা ফলাফল এমনই আশা ছিল।